Monday, September 17, 2012

ওয়েবক্যাম ডেটিংয়ে প্রতারণার ফাঁদ!

ওয়েবক্যাম ব্যবহার করে ভিডিও চ্যাটিং এখন বেশ জনপ্রিয়। কিন্তু অপরিচিত কারও সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইট ও অনলাইন ডেটিং সাইটগুলোতে এই ভিডিও চ্যাটিং বিপদের কারণ হতে পারে। সম্প্রতি বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ওয়েবক্যামে অনলাইন ডেটিংয়ের অর্থ এখন প্রতারণার ফাঁদে পা দেওয়া।
বিবিসির প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, অনলাইনে ওয়েবক্যামে সুন্দরী তরুণী আর কথার ফাঁদে পড়ে ধোঁকা খাচ্ছে পুরুষরা। প্রতারণার ফাঁদে পা দেওয়া ব্যক্তিটিকে কথার জালে আটকে ফেলে ওয়েবক্যামের সামনে তাকে নিরাবরণ হতে বলে প্রতারকরা। তারপর সে ভিডিও প্রচার করার ভয় দেখিয়ে অর্থ দাবি করে।
ফ্রান্সে ওয়েবক্যামে এ ধরনের প্রতারণার ঘটনা এখন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। ফ্রান্সের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বরাতে বিবিসি জানিয়েছে, তাদের কাছে প্রতিদিন এ ধরনের ঘটনার অভিযোগ আসে। তবে যত বেশি অভিযোগ পুলিশের কাছে আসে, তার চেয়ে বেশি ঘটনা আড়ালেই থেকে যায়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে প্রতারণার শিকার ব্যক্তিটি এ ধরনের ঘটনা প্রকাশ করতে চান না।
সম্প্রতি ফ্রান্সের ২৮ বছর বয়সী প্রতারিত এক ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাঁর অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন।
তিনি বলেন, ‘অনলাইন ডেটিং সাইট থেকে একটি মেয়ে শুরুতেই আমাকে একটা বার্তা পাঠিয়েছিল। যেহেতু সচরাচর মেয়েরা শুরুতেই এ রকম কোনো বার্তা পাঠায় না, কিন্তু অনলাইনে একটি মেয়ের কাছ থেকে প্রথম এ ধরনের বার্তা পেয়ে আমার খুব ভালো লেগেছিল। আমাকে সে প্রথম পরিচয়ে জানাল, ফ্রান্সেরই একটি শহরে তার বাড়ি। কিন্তু এখন সে ফ্রান্সে নেই। ছুটি কাটাতে আইভরি কোস্টে গেছে। পরিচয়পর্ব সেরে এমএসএন মেসেঞ্জার ব্যবহার করে আমরা কিছুক্ষণ চ্যাট করি। সে আমাকে তার একটি ভিডিও দেখায়। সে ভিডিওতে সুন্দর একটি মেয়েকে দেখে আমি মুগ্ধ হই। মেয়েটি সত্যিই সুন্দর ছিল।’
কিন্তু এ পর্যায় পর্যন্ত সব ঠিকঠাক ছিল। ভিডিওতে শালীন অবস্থাতেই তাকে দেখা গেছে। একপর্যায়ে সে আমাকে বলল, ‘আমি তার সঙ্গে সম্পর্ক আরও এগিয়ে নিতে চাই কি না। প্রথমে বুঝতে পারিনি, পরে এর অর্থ জিজ্ঞাসা করায় সে আমাকে নিরাবরণ হতে বলে। আমার সবকিছু সে দেখতে চায় বলে জানায়। এ সময় সে আরেকটি ভিডিও চালু করে, যেখানে সেও নিরাবরণ হচ্ছিল। এ ঘটনা আমাকে পুরোপুরি হতবাক করে দিয়েছিল। এ যে কোনো প্রতারণার ফাঁদ, আমার তা ধারণাতেই আসেনি। বিষয়টি আমি সত্যি বলে ধরে নিয়েছিলাম। কিন্তু আমার কাছে তার আসল উদ্দেশ্য পরিষ্কার হতে পাঁচ মিনিটের বেশি লাগেনি। এ ঘটনার পাঁচ মিনিট পর সে আমাকে একটা বার্তা পাঠাল; যাতে লেখা, “আমি তোমার যে ভিডিওটি তুলেছি, সেটা একবার দেখো। যদি এ ভিডিও প্রচার আটকাতে চাও এখনই ৫০০ ইউরো পাঠাও। এরপরই শুরু হলো হুমকি—শিগগিরই অর্থ না পাঠালে এ ভিডিওটি ইউটিউবে পোস্ট করতে যাচ্ছি।’”
প্রতারিত হওয়া ওই ব্যক্তি আরও বলেন, ‘ভিডিওতে আমাকে পুরোপুরি চেনা যাচ্ছে। আর আমাকে হুমকি দিয়ে পাঠানো লিংকটিতে অনেকেরই এ রকম ভিডিও রয়েছে; যাদের এভাবে প্রতারণার ফাঁদে ফেলা হয়েছে। দাবি না মানলে প্রতারক তখন অন্যভাবে হুমকি দিতে থাকে। ভিডিওতে প্রতারণার শিকার ব্যক্তির ব্যক্তিগত তথ্য জুড়ে দেয় ও যৌন হয়রানির অভিযোগ আনে।’
ফ্রান্সের সাইবার অপরাধ বিশেষজ্ঞ ভিনসেন্ট লিমোইন জানিয়েছেন, প্রতিদিন প্রতারণার ঘটনা বাড়ছে। তবে অনেক ক্ষেত্রে এ ধরনের প্রতারণার শিকার হওয়া ব্যক্তি তা প্রকাশ করেন না। বিষয়টি স্পর্শকাতর হওয়ায় তা প্রকাশ করতে ভয় পান ও হতাশ হয়ে পড়েন। ওয়েবক্যাম ব্ল্যাকমেইলের শিকার হওয়ার ঘটনা, তাই সচরাচর প্রকাশ্যে আসে না। যদি অর্থ পরিশোধ করা না হয়, তবে প্রতারক চক্র পুলিশের এজেন্ট হিসেবে পরিচয় দেয় ও ভুয়া কোনো ওয়েবসাইটে এ ভিডিওটি পোস্ট করে ইন্টারপোল, স্থানীয় পুলিশ বা ফ্রেঞ্চ পুলিশ হিসেবে হুমকি দিতে শুরু করে। এ ছাড়া প্রতারকরা পর্নোগ্রাফির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার অভিযোগে ভুয়া কাগজপত্র মেইল করে জরিমানা পর্যন্ত চাইতে পারে। এমনকি একবার অর্থ পেলেও বারবার বিভিন্ন ছুতোয় এরা অর্থ দাবি করে হুমকি দিতে থাকে। এ ধরনের ব্ল্যাকমেইলের একপর্যায়ে আত্মহত্যার মতো ঘটনাও ঘটছে।
এ প্রসঙ্গে ফ্রান্সের ‘লা মন্ডের’ পত্রিকার এক প্রতিবেদনে লিখেছে, অনেকেই প্রতারণার এ বিষয়টি ধরতে পারেন না। শুরুতে তাঁরা বিষয়টিকে হালকাভাবেই নেন। ‘লা মন্ডের’ সাংবাদিক লরি বেলট জানান, ল্যাপটপ বা কম্পিউটারের ওয়েবক্যামের সামনে কাপড় খোলার ঘটনা আমরা নির্বোধ লোকের কাজ বলে মনে করতে পারি, কিন্তু ভুললে চলবে না, আমাদের সমাজ একাকিত্বের সমাজ। অনেকেই রাতের বেলা তাঁদের ঘরে একা থাকেন। তাঁর সঙ্গী থাকে ইন্টারনেটযুক্ত কম্পিউটার। আমাদের একাকিত্বের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে অনলাইন ডেটিংয়ে এ ধরনের প্রতারণা বেড়েই চলেছে।
যে ব্যক্তি এ ধরনের প্রতারণার শিকার হন তাঁর উচিত কাছের মানুষের কাছে তা খুলে বলা। কারণ একাকী এ ধরনের ঘটনায় বিষণ্নতা ও উদ্বেগ বাড়তে পারে। এ ধরনের ঘটনা তরুণদের ক্ষেত্রে সবচেয়ে ঝুঁকির। তাই তাঁদের সচেতনতা জরুরি।
এদিকে কর্নেল ইউনিভার্সিটি ও ইউনিভার্সিটি অব উইসকনসিন-ম্যাডিসনের গবেষকেরা জানিয়েছেন, অনলাইন ডেটিং মানেই মিথ্যার বেসাতি। ডেটিং সাইটগুলোতে যে তথ্য দেওয়া থাকে, তাতে প্রকৃত তথ্যের চেয়ে মিথ্যাই থাকে অনেক বেশি।
গবেষকেরা অনলাইনে ডেটিং সাইট ব্যবহার করেন এমন ৭৮ জনের প্রকৃত তথ্য এবং তাঁদের আলাদা চারটি অনলাইন ডেটিং সাইটে দেওয়া বয়স, উচ্চতা ও অন্যান্য তথ্য তুলনা করে দেখেছেন, সেখানে মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। বিস্তারিত লেখার বদলে সেখানে সংক্ষিপ্ত আকারে তথ্য দেওয়া হয়েছে বা আসল তথ্য দেওয়ার পরিবর্তে ঘোরানো-প্যাঁচানো কথা সাজানো হয়েছে। গবেষকেরা দেখেছেন, ৬৫ শতাংশ ক্ষেত্রেই মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া হয়েছে।
অনলাইনে সত্য-মিথ্যার পার্থক্য বের করা মুশকিল হলেও গবেষকেরা জানিয়েছেন, অনলাইন ডেটিং থেকে বাস্তবের সঙ্গী নির্বাচনের আগে প্রকৃত তথ্য জেনে নেওয়া প্রয়োজন। কারণ, এ ক্ষেত্রে প্রতারণার শিকার হতে হয় অনেককেই। অনলাইন ডেটিংয়ে মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া হচ্ছে কি না, সেটি বের করার অনেক পদ্ধতি রয়েছে। মিথ্যা বলার কৌশলগুলো ধরতে পারলেই মিথ্যুক সঙ্গীকে বের করা বেশ সহজ। অনলাইনে সঙ্গী নির্বাচনে কৌশলী ও সচেতন হতে পরামর্শ দিয়েছেন গবেষকেরা। অনেকেই ধারণা করেন, এ ধরনের ঘটনা ঘটলে সেটা ইন্টারনেটে হয়তো সব সময় থেকে যাবে। তবে সব সময় এ ধরনের ঘটনা ঘটে না। অনেক বিষয় ইন্টারনেট থেকে মুছে ফেলা যায়, বিশেষ করে ওয়েবক্যাম ব্ল্যাকমেইলের মতো ঘটনা। ইউটিউব সাধারণত এ ধরনের ভিডিও রাখে না। এ ধরনের ভিডিও পতাকা দেখিয়ে নামিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থাও করা যায়।
এ বিষয়ে ফ্রান্সের পুলিশের পরামর্শ, কখনো প্রতারকের কথামতো কাজ করা যাবে না। তাঁর হুমকি-ধমকিকে পাত্তা দেওয়া যাবে না। আর অর্থ পরিশোধের প্রশ্নই ওঠে না। এতে করে প্রতারক হতাশ হয়ে ফিরে যাবে। এ রকমটাই ঘটেছিল ২৮ বছর বয়সী ওই ব্যক্তির ক্ষেত্রে। এ ধরনের ঘটনায় সংশ্লিষ্ট এলাকার পুলিশের কাছে ত্বরিত অভিযোগ করতে হবে।

No comments:

Post a Comment